সোমবার ২৭ অক্টোবর ২০২৫ - ১৭:১৮
হযরত জয়নাব (সা.আ.): তিনি শুধু রোগীর সেবিকা নন, ছিলেন এক আন্দোলনের রক্ষক

ইতিহাসে অনেক নারী এসেছেন—কারও পরিচয় স্নেহে, কারও ত্যাগে, কারও প্রজ্ঞায়। কিন্তু এমন নারী একটিই, যিনি একই সঙ্গে ছিলেন কারবালার শোকাহত বোন, আহতদের সেবিকা, আর এক বিপ্লবের রক্ষাকর্ত্রী। তিনি হযরত জয়নাব (সা.আ.)—যিনি শোককে শক্তিতে, বন্দিত্বকে বার্তায়, আর অশ্রুকে আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জীবন আমাদের শেখায়: একজন নারীও ইতিহাসের ধারা বদলে দিতে পারেন, যদি তাঁর হৃদয়ে ঈমানের আগুন জ্বলে।

এক মহীয়সী নারীর চিরন্তন স্মৃতি

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জন্মদিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এমন এক মহীয়সী নারীর কথা, যিনি শুধু কারবালার আহতদের সেবিকা নন, বরং ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের রক্ষাকর্ত্রী। তিনি তাঁর সাহস, জ্ঞান ও ঈমানের শক্তিতে আশুরার রক্তাক্ত বার্তাকে চিরকাল জীবিত রেখেছেন।

“জয়নাব (সা.আ.) শুধু ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর সেবিকা নন, তিনি ছিলেন কারবালার ইতিহাসের প্রাণ এবং আশুরার পরও যিনি সত্যের পতাকা উঁচু রেখেছিলেন।”

জন্ম ও মহিমা

হিজরি ক্যালেন্ডারের ৫ই জমাদিউল আউয়াল দিনটি  বীরাঙ্গনা, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর তাঁর আন্দোলনের পতাকা-বাহক, হযরত জয়নাব কুবরা (সা.আ.)এর পবিত্র জন্মদিন। এই দিনটিই পরবর্তীকালে পরিচিত হয় “নার্স দিবস” নামে।

এর কারণ, কারবালার পর হযরত জয়নাব (সা.আ.) ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর এবং আহলে বাইতের অন্যান্য আহত সদস্যদের সেবা ও পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁর অবদান কেবল সেবাযত্নেই সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি ছিলেন আশুরার বার্তার ধারক ও বাহক, যিনি বিপুল কষ্টের মাঝেও সত্যের পতাকা নামতে দেননি।

জয়নাব (সা.আ.)— সেবার ঊর্ধ্বে এক চেতনার প্রতীক

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-কে শুধু “রোগীর সেবিকা” বলা তাঁর মর্যাদার প্রতি অবিচার। যদিও সেবিকা হওয়া একটি মহান দায়িত্ব, কিন্তু তাঁর ভূমিকা ছিল অনেক গভীর—তিনি ছিলেন “আন্দোলনের সেবিকা, যিনি আত্মিক ও আদর্শিক জখম সারিয়েছেন।

“তিনি শুধু আহত শরীর নয়, আহত বিশ্বাসকে সেবা করেছেন; তিনি শুধু রোগ সারাননি, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে তুলেছেন।”

যদি হযরত জয়নাব (সা.আ.) বন্দিত্ব ও লাঞ্ছনার মাঝেও এই দায়িত্ব গ্রহণ না করতেন, তবে হয়তো ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্ত বৃথা যেত, তাঁর বিপ্লবের সত্য বার্তা মানবসমাজে পৌঁছাত না। তাঁর অদম্য ভাষণ ও সাহসী অবস্থানের কারণেই আজও আশুরার চেতনা জীবিত।

চেতনার পুনর্জাগরণের সূচনা

কারবালার ভয়াবহতার পরও হযরত জয়নাব (সা.আ.) বেলায়েতের পতাকা কাঁধে তুলে নেন। কুফা ও শামের প্রাসাদে তিনি এমন শক্তিশালী বক্তৃতা দেন, যা অত্যাচারীর মুখোশ ছিন্ন করে দেয় এবং নিস্তব্ধ সমাজকে জাগিয়ে তোলে। তাঁর আহ্বান থেকেই জন্ম নেয় “তাওয়াবিন আন্দোলন” এবং একের পর এক ইসলামী জাগরণ।

আজও, বিশ্বের প্রতিটি কোণে যখন আশুরার শোকপতাকা উড়ছে, তখন তা আসলে জয়নাব (সা.আ.)-এর সাহসী আত্মত্যাগের প্রতীক। তাঁর কারণে আশুরা কেবল ইতিহাস নয়—এটি আজও এক চলমান সত্যের প্রতিধ্বনি।

কেন তাঁর জন্মদিনকে “নার্স দিবস” বলা হয়

এই নামকরণের পেছনে রয়েছে দুটি গভীর তাৎপর্য—

১️. মর্যাদার স্বীকৃতি

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জন্মদিন পালনের মাধ্যমে তাঁর পবিত্র জীবনকে স্মরণ করা হয়। এটি সমাজে তাঁকে নারী আদর্শ ও মানবতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

২️. চেতনার প্রেরণা

এই দিনটি সেবিকা সমাজের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। এটি তাঁদের শেখায়—সত্যিকারের সেবার মূল হলো ধৈর্য, ত্যাগ ও মানবপ্রেম। যেন প্রতিটি সেবিকা, হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর মতোই সাহস, সহমর্মিতা ও দৃঢ়তায় নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

হযরত জয়নাব (সা.আ.) ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা, যিনি প্রমাণ করেছেন— একজন নারী শুধু পরিবারের নয়, বরং জাতির আত্মা ও আদর্শেরও রক্ষক হতে পারেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়— ত্যাগই মহিমা, সাহসই ঈমান, আর সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই মানবতার পরম নিদর্শন।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha